News and Technical Tips

Always stay with truth

শবে কদরের রাত: হেরা গুহায় মুহাম্মদের প্রথম ওহী [ইতিহাস ও গুরুত্ব]



শবে কদরের রাত: হেরা গুহায় মুহাম্মদের প্রথম ওহী [ইতিহাস ও গুরুত্ব]

প্রতি বছর মুসলিমরা শবে কদরের রাত মনে রেখে আধ্যাত্মিক অগ্রগতির জন্য অপেক্ষা করে। এই রাতেই বিশ্ব বদলে গিয়েছিল, যখন নবী মুহাম্মদ (সা.) হেরা গুহায় প্রথম ওহী লাভ করেন। সেই মুহূর্তে খুলে যায় চলমান নবুয়াতের দরজা, শুরু হয় ইসলামের পথচলা।

লাইলাতুল কদর শুধু একটি রাত নয়, বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য বিশুদ্ধ সত্য ও দিকনির্দেশনার সূচনা। এখানে খুঁজে পাওয়া যায় আধ্যাত্মিক শান্তি এবং মানব জীবনের নতুন অর্থ। মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের এই অধ্যায় ইসলামের ইতিহাসে যেমন মহিমান্বিত, তেমনি সবার জন্য শিক্ষা ও আশার উৎস।

সূত্র: লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

কাবা ও জাবাল নূর: হিরা গুহার পরিচিতি

আরবের মরুভূমির বুক চিরে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাবাল নূর, যার নামের অর্থ ‘আলোর পাহাড়’। ঠিক এখানেই হেরা গুহা, মুসলিম ইতিহাসে গভীর আধ্যাত্মিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করছে। মক্কার আশেপাশের পাহাড় ও উপত্যকার মাঝে এই ছোট্ট গুহা যেন মানবজাতির জন্য এক গভীর বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছে। চলুন, হেরা গুহা ও জাবাল নূরের ভূগোল, ইতিহাস ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত জানি।

জাবাল নূর ও হেরা গুহার ভৌগোলিক অবস্থান

জাবাল নূর মক্কা শহরের প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ৬৪২ মিটার উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছে এই পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি ছোট, সংকীর্ণ গুহাটি—হেরা গুহা—উপরে উঠতে ১২০০ এর বেশি সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়। গুহার গভীরতা প্রায় ৪ মিটার ও প্রশস্ততা প্রায় ১.৫ মিটার, যেখানে কয়েকজন মানুষ খুব সহজেই বসতে পারেন।

চূড়া থেকে পুরো মক্কার দৃশ্যপট চোখে পড়ে। এখানে বসে কেউ চাইলে নিঃশব্দে ধ্যান ও চিন্তায় মগ্ন হতে পারে। পাহাড়ের শিলাগুলোর গঠন তারা আগ্নেয় শিলা হওয়ায় সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না, কালক্রমে আকার বদলায় না বললেই চলে। আরও বিস্তারিত জানতে পড়ুন জাবালে নূরের পরিচয়

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

ইসলামের ইতিহাসে হেরা গুহা এক অতুলনীয় বিন্দু। এই গুহায় নবী মুহাম্মদ (সা.) নিয়মিত ধ্যান করতেন, নিজের মধ্যে শান্তি খুঁজতেন। ৬১০ সালে এই গুহায়ই প্রথম ওহী অবতীর্ণ হয়—আল্লাহপাক ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে পবিত্র কুরআনের সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত দেন।

এর দ্বারা ইসলামের শুরু হয়; নবুয়তের সিঁড়ি বেয়ে আরব থেকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে অন্ধকার কেটে আসতে শুরু করে আলোর ঝলকানি। আজও প্রতিদিন হাজারো মানুষ এই গুহার স্মৃতিবিজড়িত পাথরে ছুঁয়ে দেখে, কেউ কেউ নিজেরা সেখানে গিয়ে সময় কাটান। এখানে আসলে অনুভব হয়- যুগান্তকারী ঐতিহাসিক মুহূর্তের স্পর্শ।

বিস্তারিত জানতে পারেন হেরা গুহা আর ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণী থেকে।

আধ্যাত্মিক গুরুত্ব

শুধু ইতিহাস নয়, হেরা গুহার স্থান মুসলিমদের হৃদয়ে বিশ্বাস, ধৈর্য এবং আল্লাহর প্রতি আস্থা বাড়ানোর একটি অকৃত্রিম প্রতীক। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ধ্যান ও নির্জনতাপ্রেম এখানে এক নজির সৃষ্টি করেছে। শবে কদরের রাতে এই গুহায় তার প্রথম ওহী পাওয়া যেন আল্লাহর কৃপায় অন্ধকার থেকে আলো হয়ে ওঠার চিত্র।

গ cave-এর ছোট, নির্জন পরিবেশ মনে করিয়ে দেয়, আত্মশুদ্ধি ও চিন্তার গভীরতায় কতটা শক্তি থাকে। ইসলামে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের শুরু এখান থেকে। ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা এখনও মনে করেন, এই গুহা মানুষকে নিজের সঙ্গে ও আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়তে শিক্ষা দেয়।

আরও কিছু আকর্ষণীয় তথ্য পড়তে পারেন হেরা গুহা ও জাবালে নূরের অজানা কিছু দিক-এ।

মুহাম্মদ (সা.)-এর ধ্যান ও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি

হেরা গুহায় প্রথম ওহী লাভের আগের কয়েক বছর মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনধারা ছিল অসাধারণভাবে আধ্যাত্মিক ও একান্ত নির্জনে ডুবে থাকার দৃষ্টান্ত। চারপাশের সমাজের অশান্তি ও ভ্রান্ত বিশ্বাসে তাঁর মন ভরে উঠছিল ক্লান্তিতে। তাই তিনি প্রায়ই দুনিয়ার ব্যস্ততা এড়িয়ে নির্জনে সময় কাটাতেন, বিশেষত হেরা গুহায়। সেখানে বসে তিনি ধ্যান, চিন্তা ও আত্মবিশ্লেষণে মগ্ন থাকতেন। এই ধ্যানই ছিল সেই আলো, যা তাঁকে অন্ধকারের বাইরে বের করে এনে নবুওয়তের জন্য পরিপূর্ণভাবে তৈরি করেছিল।

ধ্যানের উদ্দেশ্য ও অভ্যাস

মুহাম্মদ (সা.)-এর ধ্যান ছিল সহজ-সরল ও গভীর আত্মসমালোচনার ফল। তিনি পথ হারানো সমাজের অবস্থা নিয়ে ভাবতেন, নিজেদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টায় থাকতেন। অনেক সময় পৰ্যন্ত তাঁর ধ্যান শুরু হতো মক্কার চারদিকের পাহাড়ে, পরে তিনি হেরা গুহাকেই মনোনীত করেন।

  • তিনি দিনের পর দিন, এমনকি কখনো কখনো টানা কয়েক রাত ও দিন ওই গুহায় একা কাটিয়ে দিতেন।
  • পরিবার ও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ সীমিত করতেন, কেবল হজরত খাদিজা (রা.) মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে যেতেন।
  • ধ্যান করার সময় তিনি নিজের হৃদয়ে এক আলাদা শান্তি ও নিশ্চয়তা অনুভব করতেন, যা পরবর্তী জীবনের বড় পরিবর্তনের জন্য তাঁকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিল।

এই ধ্যান ও আত্মসমালোচনার পাঠ মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়তের অধ্যায়ের ভিত্তি গড়ে দেয়। বিস্তারিত জানতে পারেন মহানবী (সাঃ) ধ্যান কিভাবে করতেন থেকে।

নির্জনতার শক্তি ও প্রভাব

পরিবেশের চাপ ও পরিবর্তনের মধ্যে শান্তি খুঁজে পাওয়ার জন্য নির্জনতা এক বিশাল শক্তির উৎস। মুহাম্মদ (সা.) এই নির্জনা ও অল্প কথার মধ্যে নিজের মন ও মগজকে রিফ্রেশ করতেন। আশেপাশের সমাজের অন্ধকার, কুসংস্কার ও বৈষম্যে তিনি ব্যথিত ছিলেন—তাঁর নির্জনতা ছিল নিজের মনের আলোকিত কোণ খোঁজার ব্যাপার।

পরিচ্ছন্ন হৃদয়ে, শুধু আল্লাহর স্মরণ ও অনুপ্রেরণায়, তিনি ধীরে ধীরে দুনিয়ার বাহ্যিক ঝুট-ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে থাকেন। এখানেই গড়ে ওঠে ভবিষ্যতের নবী মুহাম্মদের চরিত্র, যার জন্য তাঁকে “আমিন” (বিশ্বাসী) বলে ডাকা হতো।

আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি ও ইসলামের বীজ

মুহাম্মদ (সা.)-এর এই নির্জন ধ্যান পরিণত হয়েছিল আধ্যাত্মিক প্রস্তুতিতে। সমাজ বদলানোর জন্য প্রয়োজন ছিল ভিতর থেকে আলো জ্বালানোর, যা একমাত্র নির্জনতা ও বিশুদ্ধ ধ্যানেই পাওয়া যায়। এটি ছিল ইসলামের বীজ বপনের সময়।

নীচের তালিকার মাধ্যমে মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রস্তুতির কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো:

  • আত্মসমালোচনা: নিজের চিন্তা ও কাজ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন।
  • তাকওয়া: সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভয় ও ভালোবাসা বেড়ে ওঠে।
  • সহানুভূতি: নিপীড়িতদের জন্য সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ জন্ম নেয়।
  • পরিষ্কার মানসিকতা: বাহ্যিক জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে হূদয়ের স্বচ্ছতা অর্জন করতেন।

অন্যদিকে, ইসলামে আধ্যাত্মিকতার মূল জায়গা হচ্ছে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহভীতি—এই দুই প্রচেষ্টা মুহাম্মদ (সা.)-এর ধ্যানপর্বকে অনন্যতা দিয়েছে। আরও পড়তে পারেন ইসলামে আধ্যাত্মিকতা ও আত্মগঠনের পথ

মোট কথা, মুহাম্মদ (সা.)-এর নির্জন সাধনা ছিল আত্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস। তিনি নিজের মন ও চিন্তাকে প্রশান্ত ও প্রস্তুত রাখতেন—এটাই ছিল তাঁর নবুওয়তের প্রথম পাঠ।

ওহির ঘটনা: শক্তির রজনীতে দেবদূত জিবরাইলের আগমন

শবে কদরের সেই ঐতিহাসিক রাতে, হেরা গুহায় মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। অন্ধকার গুহায় আলোর নতুন বার্তা নিয়ে নেমে আসেন দেবদূত জিবরাইল (আ.)। এই মুহূর্তটাই ছিল মানব ইতিহাসের জন্য আশ্চর্য এক বাঁক: একটি বার্তার শুরু, যা সভ্যতার চালচিত্র একেবারে বদলে দেয়। চলুন, প্রথম ওহির অনুভূতি, 'ইকরা' আদেশ, মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতিক্রিয়া এবং আল-কুরআনের সূচনাপর্ব নিয়ে গভীরভাবে জানি।

প্রথম ওহির মুহূর্ত ও জিবরাইলের উপস্থাপনা: জিবরাইল (আ.)-এর আগমনের বর্ণনা, 'ইকরা' আদেশ এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতিক্রিয়া

মুহাম্মদ (সা.) যখন নির্জনতায় ডুবে হেরা গুহায় ধ্যান করছিলেন, তখন আচমকা তাকে ঘিরে ধরলো এক অভূতপূর্ব শক্তি। সেই গভীর নীরবতার মাঝে উপস্থিত হন দেবদূত জিবরাইল (আ.)।

  • জিবরাইল (আ.)-এর পরিচয়: ফেরেশতাদের মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ, আকাশ ও পৃথিবীর বার্তা বাহক।
  • ঐ রাতের আবহ: নীরব চারিদিকে, কেবল মুহাম্মদ (সা.) হাতের মুঠোয় শান্তি জড়িয়ে, হঠাৎ এক অজানা আতঙ্ক।
  • প্রথম আদেশ: জিবরাইল (আ.) মুহাম্মদ (সা.)-কে শক্ত কণ্ঠে বললেন, "ইকরা"—অর্থাৎ "পড়ো"।

মুহাম্মদ (সা.) তখন বললেন, “আমি তো পড়তে জানি না!”
জিবরাইল (আ.) তাকে চেপে ধরলেন এবং বারবার বললেন, "ইকরা"।
অজানা, আশ্চর্য অভিজ্ঞতায় মুহাম্মদ (সা.) প্রবলভাবে কাঁপছিলেন। এই অনুভূতির গভীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পড়তে পারেন জিবরাঈল (আঃ)-এর আগমনের বিস্তারিত বিবরণওহী নিয়ে জিবরাইলের আগমন থেকে।

মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই মানবিক—ঘেমে উঠেছিলেন, কাঁপছিলেন, ভীত হয়েছিলেন। তিনিই পরে বারবার বলেন, "আমাকে কাপড়ে জড়িয়ে দাও!" এই দুর্দান্ত অনুভূতির চাপে তাঁর মনে উঠেছিল নতুন আত্ম-অনুসন্ধান ও সংশয়। পরে পরিবারের কাছে ফিরে এসে স্ত্রী খাদিজার (রা.) সমর্থন ও সান্ত্বনা পান। এই অভিজ্ঞতাই নবুওয়তের দায়িত্বের প্রথম স্বাদ দেন মুহাম্মদ (সা.)-কে।

সূরা আলা‘লাকের প্রথম আয়াতসমূহ: প্রথম পাঁচ আয়াত, তাদের ভাবধারা ও ইসলামে জ্ঞান ও শিক্ষার গুরুত্ব

প্রথম ওহির মাধ্যমে আল্লাহ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে কুরআনের সূচনাটি দিয়েছিলেন সূরা আলাক-এর ৫টি আয়াত পাঠ করিয়ে। এই পাঁচটি আয়াতই মুসলিম জীবনে জ্ঞান ও শিক্ষার গুরুত্ব প্রকাশ করে।

  • আদেশের শুরু:
    "পড়ো তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।
    মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে।
    পড়ো—তোমার প্রতিপালক শ্রেষ্ঠ,
    যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন,
    তিনি মানবজাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা তারা জানত না।"

এই আয়াতগুলো বুঝিয়ে দিল—জ্ঞান, শিক্ষা এবং কলমের প্রতি ইসলামের প্রথম আহ্বান। মহানবীর সময়কার সমাজে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল খুব সীমিত, তাই এই প্রথম আহ্বানই ছিল বিপ্লবী। আলো ও অজ্ঞতার মধ্যকার সেতুবন্ধ গড়ে দিয়েছিল এই পাঁচটি আয়াত।

এখানে সংক্ষেপে আয়াতগুলোর ভাব ও গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:

আয়াত বিষয়বস্তু মুখ্য বার্তা
পড়ো, সৃষ্টি সৃষ্টিকর্তার নামে পড়া, শিক্ষার শুরু
মানুষের সৃষ্টি মানুষের বিনয় ও শুরু
শ্রেষ্ঠত্ব আল্লাহর বড়ত্ব, জ্ঞানেই মহানতা
কলম ও শিক্ষা লেখার শক্তি, কলমের মর্যাদা
অজানা জ্ঞান মানুষকে শেখানো—জ্ঞানই সমৃদ্ধি

এই আয়াতগুলো কুরআনের শিক্ষা ও ইসলামের মূল আধারকে নির্দেশ করে: শিক্ষা, চিন্তা ও আত্মউন্নয়ন ইসলামের আদি ভাষণেই বলা হয়, জ্ঞানের খোঁজে থাকো—এমনকি সেটা দূর যুগে গেলেও।

কুরআনের সূরা আল-আলাকের তাফসীর পড়লে বোঝা যায়, এখানেই মুসলিমদের আত্মনির্মাণ ও চিন্তার চেতনা নিহিত। প্রথম ওহির রাতের মর্ম ছিল—তোমার যাত্রা জ্ঞানের দিকে, কলমের প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রতিপালকের নামে জীবন গড়া।
জ্ঞান, শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধির সূত্রপাত হয় এই পাঁচটি আয়াতের মাধ্যমে—শক্তির রজনীতেই বাংলার মুসলিম হৃদয়ে গেঁথে যায় শিক্ষার অমর বার্তা।

ওহির পরবর্তী ঘটনা ও খাদিজা (রাঃ)-এর সহায়তা

ওহির পরে মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন মুহূর্তেই বদলে যায়। অজানা শক্তির ছোঁয়া ও জিবরাইল (আ.)-এর আদেশ তাঁর মনে প্রবল আতঙ্ক আর ধাঁধার সৃষ্টি করেছিল। হেরা গুহা থেকে নেমে আসার পরই শুরু হয় বাস্তব ও মানসিক এক অস্থিরতার অধ্যায়—যার কেন্দ্রে ছিল পারিবারিক ভালোবাসা, সহানুভূতি আর প্রজ্ঞার ছোঁয়া। এই পদক্ষেপেই গড়ে ওঠে নবুয়তের বিশ্বাস এবং ইসলামের নতুন ধারা। আসুন, এবার ওহির পরবর্তী মুহূর্ত, খাদিজা (রাঃ)-এর সান্ত্বনা, এবং ওয়ারাকা ইবনে নওফেল-এর প্রজ্ঞাময় উপদেশ নিয়ে বিশদে জানি।

মুহাম্মদ (সা.)-এর মানসিক অবস্থা: আশ্চর্য, আতঙ্ক ও নির্ভরতাবোধ

ওহি প্রাপ্তির অভিজ্ঞতা মুহাম্মদ (সা.)-এর মনে গভীর এক আতঙ্ক জাগিয়ে তোলে। তিনি গুহা থেকে ফিরেই কাঁপতে কাঁপতে স্ত্রী খাদিজা (রাঃ)-এর কাছে যান। মুহূর্তে তাঁর মুখে ছিল এই আর্তি: “আমাকে ঢেকে দাও, আমাকে ঢেকে দাও!” সেই গভীর রাতে প্রিয় নবীর স্থিরচিত্র—অভূতপূর্ব, অনিশ্চয়তায় ভরা, ভাবনার ভারে তিনি কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। কেউ এমন অবস্থায় পড়লে যেমন ব্যাকুল হয়, তিনিও ঠিক তেমনই ছিলেন, যেন পৃথিবী এক লহমায় বদলে গেছে।

এই অবস্থা নতুন দায়িত্বের, ভয় ও কৌতূহলের মিশেলে উপচে পড়ছিল। মুহাম্মদ (সা.)-এর আতঙ্ক ছিল দ্ব্যর্থবোধক—একদিকে স্বর্গীয় সত্য, অন্যদিকে নিজেকে নিয়ে সংশয়। নিজের প্রতি তাঁর মনে জন্ম নিয়েছিল “আমি কি সত্যিই নবী?”-এর মতো প্রশ্ন।

খাদিজা (রাঃ)-এর অসাধারণ সহানুভূতি ও সাহস

এই সংকটের ঘোরলাগা মুহূর্তে খাদিজা (রাঃ) স্বামীকে সান্ত্বনা দেন—একজন আদর্শ জীবনসঙ্গিনী আর আশ্রয়দাত্রী। তিনি মুহাম্মদ (সা.)-কে চাদরে মুড়িয়ে শান্ত করেন। সংবেদনশীল কণ্ঠে বলেন, “আল্লাহ কখনো আপনাকে লজ্জায় ফেলবেন না। আপনি পরিবারকে ভালোবাসেন, সত্য বলেন, দলিতদের পাশে থাকেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করেন, অসহায়ের পাশে দাঁড়ান। এমন ভালো মানুষকে এগুলো কিছুতেই বিপদে ফেলতে পারে না।”

খাদিজা (রাঃ)-এর এই স্ত্রীর মতো নিঃস্বার্থ সহানুভূতি মুহাম্মদ (সা.)-এর আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনেন। তাঁর সান্ত্বনাময় কথা ও উপস্থিতি চুপচাপ শক্তি জুগিয়েছে এই নবচিন্তিত নবীকে। অনেক গবেষক ও ইসলামিক ইতিহাসবিদ এই ঘটনা সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনের উজ্জ্বল নজির মনে করেন। আরও পড়ুন খাদিজা (রাঃ)-এর জীবনের অবদান ও গুরুত্ব

খাদিজা (রাঃ)-এর কার্যকরী পদক্ষেপ (এক নজরে)

  • নবীজিকে চাদরে মুড়িয়ে শান্ত করা
  • তাঁর সততা, সহানুভূতি ও সতর্কতাকে মনে করিয়ে দেওয়া
  • সমস্যা বিশ্লেষণের জন্য বিশেষজ্ঞ ধর্মজ্ঞের কাছে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া

ওয়ারাকা ইবনে নওফেল-এর জ্ঞানগর্ভ পরামর্শ

খাদিজা (রাঃ) পরিস্থিতি আন্দাজ করে তাঁর চাচাতো ভাই, প্রখ্যাত খ্রিস্টান পন্ডিত ওয়ারাকা ইবনে নওফেল-এর কাছে নবীজিকে নিয়ে যান। ওয়ারাকা ছিলেন ধর্মীয় জ্ঞান ও আসমানী কিতাবের পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। নবীজির বর্ণনা শুনে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, “এটি ঠিক সেই ফেরেশতাই, যিনি মূসা (আ.)-এর নিকট এসেছিলেন। আপনি এই উম্মতের নবী।”

ওয়ারাকার এই ঘোষণায় মুহাম্মদ (সা.)-এর মনে কিছুটা দৃঢ়তা আসে। ওয়ারাকা তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, “আপনাকে তোমার জাতি অস্বীকার করবে, বিরোধিতা করবে। কিন্তু আপনি সত্য ও ন্যায়ের জন্য অবিচল থাকুন।”
এই পরামর্শ ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশনা দেয়—নবুওয়তের পথে সাহসের বাতিঘর ছিল ওয়ারাকার আন্তরিকতা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা। আরও জানতে পারেন ওয়ারাকা ইবনে নওফল সম্পর্কে

ওয়ারাকার কথার গুরুত্ব

  • নবুওয়তের সত্যতা ও গুরুত্ব সংক্রান্ত আশ্বাস প্রদান
  • ভবিষ্যতের প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জের পূর্বাভাস
  • নবীজিকে দ্বীনের দায়িত্ব দৃঢ়তার সঙ্গে গ্রহণের উৎসাহ

ওহির অভিজ্ঞতা মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে এক নতুন শক্তি জাগিয়েছিল। তাঁর দুর্বলতার এই মুহূর্তগুলোতে স্ত্রী খাদিজা (রাঃ)-এর ভালোবাসা ও ওয়ারাকা ইবনে নওফেল-এর সমর্থন আশার আলো হয়ে আত্মবিশ্বাসের ভিত শক্ত করেছিল। এই অধ্যায়ই শুরু হয়েছিল নবুয়তের পথ—যেখান থেকে বিশ্ব নতুন বার্তা পেয়েছিল।
বিস্তারিত জানতে পড়ুন রাসুল (ﷺ)-এর প্রথম ওহী লাভ ও ওয়ারাকার পরামর্শ

ইসলামের সূচনা ও প্রথম ওহির প্রভাব

হেরা গুহায় প্রথম ওহি পাওয়ার সেই রাত ছিল ইতিহাসের এক মোড়বদলের মুহূর্ত। মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে আল্লাহর বাণী মানবজাতির কাছে নতুন জীবন আর নৈতিক পথ দেখানো শুরু করল। এই প্রথম ওহির ফলেই ইসলামের বীজ রোপিত হয়েছিল মক্কার বুকে। সেই ওহি ছিল জ্ঞানের গুরুত্ব, একেশ্বরবাদ, নৈতিকতাবোধ আর সমাজ সংস্কারের নামে একটি আলাদা আহ্বান।

মক্কার সমাজে মুহাম্মদ (সা.)-এর আহ্বান ও প্রতিক্রিয়া: প্রথম ওহির আলোকে মক্কার কুরাইশদের মনোভাব, বিরোধিতা এবং নবুয়তের চ্যালেঞ্জ

ওহি পাওয়ার পর মুহাম্মদ (সা.) কুরাইশদের কাছে আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেন। আগে তিনি সমাজে ‘আমিন’ (বিশ্বাসী) নামে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু নবুয়তের আহ্বান দেয়ার পর তার আগের সেই সম্মান অনেকের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।

কুরাইশদের মনোভাব ও সতর্কতা

মক্কার কুরাইশরা ছিল এক ঐতিহ্যপ্রেমী, সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী বংশ। তাদের বিশ্বাস, ব্যবসা, সামাজিক বন্ধন ছিল বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা বিধান আর পৌত্তলিকতায় গাঁথা। মুহাম্মদ (সা.)-এর একেশ্বরবাদী আহ্বান তাদের জন্য এক অস্বস্তিকর বার্তা ছিল, কারণ এর ফলে কাবাঘর কেন্দ্রিক তাদের দেবতার ব্যবসা আর সামাজিক কাঠামোতে চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়।

  • তারা প্রথমে ঘটনাটিকে অবিশ্বাস করে ও পাত্তা দেয়নি
  • ধীরে ধীরে বিরোধিতার মাত্রা বাড়ে: কেউ কটূক্তি, কেউ উপহাস, কেউ বা পরিবারিক-সামাজিক বয়কট শুরু করে দেয়
  • সমাজের চালিকা শক্তিরা তাকে মিথ্যাবাদী, কবি, পাগল বলে আখ্যা দেয়
  • নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে যেন তিনি তার আহ্বান বন্ধ করেন

প্রথম ওহির আলোকে নবুয়তের চ্যালেঞ্জ

ওহির আওয়াজ কারও কাছে ছিল মুক্তির, আবার কারও কাছে ছিল হুমকি। মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এই নতুন সত্যের আলোকে সমাজে দাঁড়িয়ে থাকা ও পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশীদের অবিশ্বাসের মুখোমুখি হওয়া।

  • সবচেয়ে কাছের মানুষও অনেক সময় পাশে দাঁড়ায়নি
  • ব্যবসায়ীক ক্ষতি, নিগ্রহ, হাস্যরস, এমনকি প্রাণনাশের হুমকিও আসে
  • কুরাইশরা অর্থ-সম্পদ ও সামাজিক প্রতিপত্তি দিয়ে মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রভাবিত করার বহু চেষ্টা করে, কিন্তু তিনি সত্যের দায়ে অটল থাকেন

এই সমাজ-প্রতিক্রিয়ার মাঝে ইসলামের বীজ

মুহাম্মদ (সা.) জানতেন, সমাজ বদলাতে গেলে প্রথমেই আসে প্রতিরোধ। নিজ শহরের মানুষই সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল তাঁকে। অথচ, প্রথম ওহির শিক্ষা ছিল গভীর ও সময়োপযোগী:

  • জ্ঞান ও কলম: ‘ইকরা’ আদেশের মধ্যেই ছিল প্রচলিত অজ্ঞতার অন্ধকার ভেদ করার মূলমন্ত্র
  • একেশ্বরবাদ: এক আল্লাহর আহ্বান সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় মূর্তিপূজার ওপর
  • নৈতিকতা ও মানবিক দায়: সততা, সহানুভূতি, ন্যায়-এইসব আদর্শ উঠে আসে জীবনযাপনের ন্যূনতম শর্ত হিসেবে
  • সমাজ সংস্কারের ডাক: গরিব, নিপীড়িত, অনাথ—সমাজের উপেক্ষিত মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু হয়

এর ফলেই ইসলামের শুরুটা মক্কার চোখে অস্বস্তিকর হলেও, চূড়ান্তভাবে এই বার্তাই সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবীর কোটি মানুষের হৃদয়ে পোঁছে যায়।

বিশদ জানতে পড়ুন মুহাম্মাদের প্রথম ওহী আর নবীজি (সা.)-এর প্রথম ওহির পর প্রতিক্রিয়া

প্রথম ওহি শুধু নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নয়—বরং মক্কা সহ পুরো মানবজাতিকেই নাড়া দিয়েছিল; যে ওহিতে ছিল আলোর বীজ, আরবের রাতকে ভোরের দিকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ।

0 Comments:

Post a Comment

BBC News

Featured Post

AdSense Auto Ads: Machine Learning Placements, Higher RPM, Easy Setup

Auto Ads That Feel Invisible: How Machine Learning Finds Profitable Ad Spots AdSense Auto Ads: Machine Learning Placements, Higher RPM, Easy...

Al Jazeera – Breaking News, World News and Video from Al Jazeera

Latest from TechRadar

CNET